আগাছা

বাবা দিবস (জুন ২০১৩)

আশিষ বিশ্বাস
  • ৪৫
খুব উত্তেজনা হচ্ছে আমার নিজস্ব বাড়ীর গৃহ প্রবেশ। নিজেকে সক্ষম পুরুষ মনে হচ্ছে আমার। অনেক রাত হয়ে গেল, উত্তেজনায় ঘুম আসছে না। পাশে স্ত্রী আর শিশু পুত্র অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ওদের বিরক্ত করা উচিৎ হবে না, কাল এত বড়ো একটা অনুষ্ঠান, এত লোকের আগমন ঘটবে, তাদের দেখভাল করতে হবে। কিন্তু আমার তো ঘুম আসছে না। বাইরে ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। ঘর থেকে বের হয়ে ব্যালকনি-তে এসে বসলাম। কত কথা মনে পড়ছে। ছোট বেলা কী কষ্টে না কেটেছে। আদর্শবান শিক্ষকের সন্তান ছিলাম আমরা ছয় ভাই-বোন। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপ ছিল কঠিন সংগ্রাম। প্রতিটা দিন-ই স্মৃতি। কিন্তু এখন আমি সফল মানুষ। ভালো চাকরি, ভালো মাইনে, সঙ্গে আকর্ষণীয় উপরি, অফিস-ও কাছেই। আমার পৈত্রিক বাড়ী ছেড়ে পাশেই একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকছি এখন। মা তো ইতিমধ্যে গত হয়েছেন। বাবার দেখাশোনার দায়িত্ব আমি পালন করছি নিষ্ঠা সহকারে, তাকে একটা বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়েছি। তাঁর জন্যে আমার আর্থিক দায়-দায়িত্ব পালন করতে হয় না বলরেই চলে। বাবার পেনশনের টাকায়-ই তা হয়ে যায়। আমি মাসে মাসে দেখা করে আসি তার সঙ্গে। বৃদ্ধাশ্রমটি বেশী একটা দূরে নয়। আমি সময় না পেলে আমার স্ত্রী-ও কোনো কোনো মাসে দেখা করে আসে। বাবা আমার ছেলেকে আদর করে, চকলেট-বিস্কুট হাতে দেয়, যদিও বেশির ভাগ সময় সেগুলি বাড়ীতে এলে ডাস্টবিনে চলে যায় কেননা আমার স্ত্রী খুব স্বাস্থ্য সচেতন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে আনা কোনো জিনিস ছেলেকে বা আমাকে খেতে দেয় না, নিজেও খায় না। আমি এই শহরতলীতে ইতিমধ্যে আমাদের এই পাড়ায়-ই একটুকরো জমি কিনেছি, একটা বাড়ি বানিয়েছি, এখানকার লোক-জনেরা বলাবলি করে যে আমার বাড়ীটা নাকি এই এলাকার মধ্য সবচেয়ে আকর্ষনীয়। এসব শুনে আমার অহংকার হয়। কাল গৃহপ্রবেশ সেই বাড়ীতে। নিয়ম অনুসারে গৃহ প্রবেশ না করে সেখানে রাত্রি যাপন করা যাবে না। তাই সব মাল-পত্র সেখানে সাজিয়ে গুছিয়ে এসেছি, রাতটা কাটলেই সেখানে যেতে হবে, নিয়ম-কানুন সারাতে হবে, অতিথি আপ্যায়ন করতে হবে- অনেক কাজ! চিন্তা যেমন হচ্ছে, উত্তেজনাও হচ্ছে তেমন। আমার নিজের উপার্জনে জমি-বাড়ি তাও এতো বিলাস-বহুল, ভাবতেই পারছি না! বাবার আদর্শবাদী জীবনে থেকে এত সাফল্য কি সম্ভব হতো! বাবা তো আমাদের গৃহ শিক্ষক পর্যন্ত দিতে পারে নি, নিজেই সকাল- সন্ধ্যা পড়াতেন গ্রামার, অঙ্ক - সব। রিটায়ার করবার পরও বাবার হাতে প্রায় কিছুই নেই বললেই চলে। বাড়ী সেই পূর্ব পুরুষের বানানো, সংস্কার করবার ক্ষমতাও বাবার হয় নি কোনোদিন। আর আমি আমার ছেলেকে ভর্তি করিয়েছি নামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে, নামী নামী মাস্টার দিয়েছি বাড়ীতে পড়াবার জন্যে। বাবাকে আমার বাড়ী বানাবার কথাটা বলেছি, কিন্তু গৃহ প্রবেশ আসতে বলি নি ইচ্ছে করেই, পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে অসুবিধে হবে ওনার। মিস্ত্রীদের কাছে শুনেছি বিকেলে হাটতে বেরিয়ে বাবা নাকি প্রায়-ই এসে দেখ যান কাজ-কর্ম।
বৃষ্টিটা কমল। মনে হলো যাই একটু দেখে আসি বাড়ীটা। কল থেকে তো থাকতেই হবে ওখানে, তাছাড়া সব মাল-পত্র ওই বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, শুধু তালার উপর নির্ভর করে পড়ে আছে সব। হাতে টর্চ নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেরোলাম। পড়ার মোড় পেরিয়ে ডানদিকে ঘুরে গেলাম। আর একটু এগিয়েই আমার স্বপ্নের বাড়ি। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই একটু থমকে দাঁড়ালাম। বাড়ির ওখানে কেউ একজন হাঁটাহাঁটি করছে না? ভালো করে নজর করে দেখার চেষ্টা করলাম। হ্যাঁ ঠিক-ই, নিশ্চয়-ই চোর হবে। সামনের একটা গাছের পেছনে লুকিয়ে পড়লাম আর লক্ষ্য করতে থাকলাম চোরটির গতিবিধি। চোরএর বেরুবার পথ তো একটাই, এই দিকে আসা ছাড়া ও রেরুতেই পারবে না। একসময় দেখি চোরটা আসছে আমার দিকেই। আমি প্রস্তুত হলাম কাছে এলেই ঝাঁপিয়ে পড়ব ওর ওপরে। ধীরে ধীরে সে আসছে। একদম কাছে আসতেই টর্চ ওর মুখের ওপরে মেরে একলাফে একেবারে সামনে - কে?
কিন্তু মুহূর্তে চুপসে গেলাম: বাবা আপনি? এত রাত্রে?
- হাঁটতে হাঁটতে দেখতে এলাম বাড়ীটা, দিন কালের অবস্থা তো ভালো নয়, যে হারে চোর ডাকাতের উপদ্রব। তাই একটু দেখাশোনা করে গেলাম।
- কিন্তু আপনি ঘুমোন নি এখনো?
- বুড় বয়সে তো ঘুম কমে যায় বাবা। তাছাড়া খুব চিন্তা হচ্ছিল ফাঁকা বাড়িটার কথা ভেবে। তাই হাঁটতে হাঁটতে...
বাবা ধীর গতিতে চলতে লাগল বৃদ্ধাশ্রমের দিকে। আমি নিস্পলক তাকিয়ে রইলাম পথের দিকতে। আমার জন্যে এই লোকটার এত গভীর চিন্তা! এত রাতে এতটা পথ হেঁটে এসেছেন শুধুমাত্র আমার ক্ষতির কথা ভেবে! চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছিল। মনে পড়ল ভোলা স্যারের কথা। দীর্ঘ দেহী এই মানুষটা আমাদের স্কুলে বাংলা পড়াতেন, কথা এবং কাজে কঠিন আদর্শবাদী। গুরুগম্ভীর কণ্ঠে প্রায়-ই তিনি বলতেন, যারা সমাজের মধ্যে বেড়ে ওঠে কিন্তু সমাজের কোনো উপকারে লাগে না তারা হল সমাজের আগাছা, এদের প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। মাথা নিচু করে ঘরে ফিরে এলাম।
বিছানায় শুয়ে আমার ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কানে ফিস ফিস করে বলরাম, সোনারে আমার, ভেষজ হয়ে উঠিস, আগাছা নয়।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সুজিত দেব রায় আমার খুব ভালো লাগলো ...............

২৪ এপ্রিল - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪